ঢাকা, বাংলাদেশ রবিবার ১৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ আর্কাইভ
হোম  »  আজকের সংবাদবিশেষ সংবাদরাজনীতি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দম্ভ, দুর্বৃত্ত ও আতঙ্কের নাম মোকতাদির চৌধুরী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-বিজয়নগর, সরাইল ও আশুগঞ্জের রাজনীতি, ত্রাসের রাজত্ব, সন্ত্রাস, মাদক, টেন্ডারবাজী, নিয়োগ বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য, ভূমিদস্যু, জলাশয় ভরাট ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
প্রথম পর্ব……

ছবি: সংগৃহিত

সোহেল আহাদ, আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়া: মাদকের তালিকাভূক্ত কারবারি, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, নিয়োগ বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য, ভূমিদস্যু, জুয়ারী ও চাটুকার এই সাত শ্রেণির মানুষকে সব সময় নিজের চারপাশে রাখতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর -৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। জেলার চারপাশের উপজেলাগুলোর রাজনীতি, অপরাধ ও টেন্ডারবাজী একক নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেই দলের নেতাকর্মী, বিরোধী দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ সাধারণ মানুষ ভয় পেত। দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাদের কমিটি থেকে বাদ দিয়ে তার পকেটে থাকা লোকদেরকে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে দলের তৃণমূল থেকে সিনিয়র নেতারাও ক্ষুদ্ধ ছিলেন। সদর ও বিজয়নগর-৩ আসনে সংসদ সদস্য পদে শক্ত প্রার্থী না থাকার ফলে একক আধিপত্য বিস্তার করেন মোকতাদির। শহরে কাকে মেয়র বানাতে হবে, কাকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে হবে, কাকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনোনয়ন দিতে হবে, জেলা আওয়ামীলীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কাকে সভাপতি/সম্পাদক বানাতে হবে তার সবই একক নিয়ন্ত্রণ ছিল মোকতাদিরের হাতে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, এলজিইডি, জেলা রেজিস্ট্রারারের কার্যালয়, বিআরটিএ এবং পাসপোর্ট অফিসও তার নিজস্ব লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব দপ্তরগুলো নিয়ন্ত্রণ করাতেন তার এপিএস আবু মূসা আনসারী, এইএম মাহবুব, হামিদুর রহমান হামদু, আলী আজম নামক ব্যক্তিদের মাধ্যমে।

মোকতাদিরের উত্থান: ব্রাহ্মণবাড়িয়া তৎকালীন মহকুমার চিনাইর গ্রামে ১৯৫৫ সনে জন্মগ্রহণ করেন মোকতাদির চৌধুরী। তার প্রাথমিক শিক্ষা নারায়ণগঞ্জ থেকে শেষ করে ১৯৬৯ সনে ঢাকার আলীয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল পাশ করে ১৯৭২ সনে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। মাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুছ মাখনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে মোকতাদিরের। তখন থেকেই তার উগ্রতা, বদ মেজাজ এবং সিনিয়র নেতাদের সাথে বেয়াদবি আচরণ করতে থাকে। আবদুল কুদ্দুছ মাখন অসংখ্যবার তাকে শারীরিক অপদস্থ করলেও স্বভাব চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেনি মোকতাদির চৌধুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হলে নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত বাড়তে থাকে মোকতাদিরের। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে মোকতাদির ও শেখ রেহানার সাথে প্রণয়ের গুঞ্জন সৃষ্টি হলে শেখ কামাল মোকতাদিরকে ৩২ নাম্বার বাড়িতে প্রবেশে নিষেধ করে। তবে শেখ রেহানার সাথে প্রণয় চলতে থাকে। দলের সিনিয়র নেতাদের কাছে মোকতাদির একজন দম্ভ, বদ মেজাজি এবং বেয়াদব হিসেবে পরিচিত। এসবের কারণে শেখ হাসিনা নিজেও মোকতাদিরকে অপছন্দ করতেন। শেখ হাসিনা তাকে দলের মনোনয়ন দিতে না চাইলেও শেখ রেহানার সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে শেখ রেহানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর-৩ আসন বারবার মোকতাদিরকে দলের মনোনয়ন দিতে থাকে।

এছাড়াও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক উবায়দুল কাদের ও মোকতাদির চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি একসাথে করার সুবাদে তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার ফলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন মোকতাদির চৌধুরী।

ছবি: সংগৃহিত

বিসিএস ক্যাডারে যোগদান: ১৯৮৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হারুনুর রশিদের প্রত্যয়নপত্রে সিভিল সার্ভিসে (প্রশাসন ক্যাডার) মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগদান করেন মোকতাদির চৌধুরী। ১৯৯৬ সনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক একান্ত সচিব হিসেবে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাজনীতিতে প্রবেশঃ সরকারি চাকুরি করার ফলে সরাসরি আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যক্রমে যুক্ত হতে না পারলেও নেপথ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগকে দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রথম ধাপ শুরু করেন এডভোকেট হুমায়ুন কবিরের মাধ্যমে। মোকতাদির চৌধুরী ২০০১ সনের নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এডভোকেট হুমায়ুন কবিরকে সরাইল ২ আসনে নির্বাচনী জনসভাসহ যাবতীয় প্রচার কার্যক্রমে এগিয়ে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ২ ও ৩নং  সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা উপদেষ্টা প্রয়াত সংসদ সদস্য বর্ষীয়ান নেতা এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুকে দল থেকে নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্র শুরু করেন মোকতাদির চৌধুরী। ২০০১ সনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মোকতাদিরের মনোনয়ন পাওয়া অনিশ্চিত হলে তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুর মনোনয়ন বাতিল করে হুমায়ুন কবিরের অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসনে মনোনয়ন পাইয়ে দেন মোকতাদির চৌধুরী।

২০০১ সনে বিএনপি প্রার্থী এডভোকেট হারুণ আল রশিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে জেলা আওয়ামীলীগে মোকতাদিরের দাপট আরো তীব্র হয়ে উঠে। তখন থেকে আওয়ামীলীগে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেন মোকতাদির চৌধুরী। এরই মাঝে মোকতাদির চৌধুরী ধীরে ধীরে হুমায়ুন কবিরকে ব্যবহার করে ছেড়ে দিয়ে পিছু হটতে থাকে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০০৩ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর মিলনায়তনে জেলা আওয়ামীলীগের বর্ধিত সভায় ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রলীগের ভিপি হাসান সারোয়ার হুমায়ুন কবিরকে জনসমক্ষে থাপ্পড় মারলে মোকতাদির চৌধুরী এবং হুমায়ুন কবিরের দ্বন্দ্বটি প্রকাশ্যে চলে আসে। মোকতাদির চৌধুরী সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার আসামী মেজর জহির, জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুছ মাখনের ছোট ভাই জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন ও বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল বারী চৌধুরী মন্টুসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে আওয়ামীলীগে নতুন গ্রুপিং তৈরি করে।

অন্যদিকে জেলা আওয়ামীলীগের মূল ধারার নেতাদের মধ্যে এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুর নেতৃত্বে তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা এডভোকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আমানুল হক সেন্টু, মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মিনারা আলম, দিলারা হারুণ এমপি, শফিকুল আলম এমএসসি, মাহবুবুল আলম খোকন, জেলা যুবলীগ ও জেলা ছাত্রলীগ ছিল মূল ধারার নেতৃত্বে। ২০০৬ সনে দল থেকে মোকতাদির চৌধুরী মনোনয়ন পেলেও ২৮ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সন্ধ্যায় জেলা বিএনপির শান্তি মিছিলে মোকতাদির চৌধুরীর নির্দেশে ছাত্রলীগের এক পক্ষের বোমা হামলায় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এডভোকেট শেখ মো. হাবিবুল্লাহ মৃত্যুর অভিযোগও উঠে। বিএনপি নেতা হাবিবুল্লাহ্ হত্যা মামলা ও একাধিক দুর্নীতি মামলায় মোকতাদির চৌধুরী দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলে এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুকে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়।

সংসদ সদস্য নির্বাচিতঃ এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু ২০১০ সনের ২২ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে মোকতাদির চৌধুরীর ভাগ্য খুলে যায়। ২০১১ সনের ২৭ জানুয়ারি উপ-নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোকতাদির। যদিও সে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও রয়েছে। সংসদ সদস্য হয়ে শুরু করেন মোকাতাদির চৌধুরীর একক রাজত্ব, আধিপত্য ও দুর্বৃত্তায়ন। মোকতাদির চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সনে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরে জিয়ারত করে ফেরার পথে তৎকালীন ছাত্রলীগের ১২ জন নেতা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে শহরে শোকের মাতম শুরু হয়, যা মোকতাদিরের জয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর অভিশাপ ও কালো অধ্যায় হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারী হেলাল উদ্দিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা নির্বাচনে প্রয়াত এমপি লুৎফুল হাই সাচ্চু’র অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাজী মাহমুদুল হক ভূইয়া দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাহমুদুল হক মেয়র নির্বাচনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার ভয়ে মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারী বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট জহিরুল হক ভূইয়াকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট করে নির্বাচন স্থগিত করিয়ে দেন। একমাস পর পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাচন হলে হেলাল উদ্দিনকে মেয়র হিসেবে জয়ী ঘোষণা করেন।

ছবি: সংগৃহিত

যেভাবে মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারীদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু: ২০১৪ সনে জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনের পূর্বে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র হেলাল উদ্দিন দলের সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হলে মোকতাদির ও হেলাল নিরব দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। মেয়র হেলালকে দলের সকল কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্র প্রখর হতে থাকে মোকতাদিরের। সম্মেলনে মোকতাদির চৌধুরী সভাপতি হয়ে মেয়র হেলালকে দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি করা হয়। অন্যদিকে হেলাল উদ্দিনের প্রতিপক্ষ আল মামুন সরকারকে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন মোকতাদির চৌধুরী। যদিও আল মামুন সরকার দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া মোকতাদির যুগে দুঃস্বপ্ন ছিল।

২০১৬ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাচনে হেলাল উদ্দিন পুনরায় মেয়র পদে নির্বাচন করতে চাইলে হেলাল উদ্দিনের প্রতিপক্ষ ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ও মোকতাদির চৌধুরীর যোগসাজশে হেলাল উদ্দিনকে দল থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন না দিয়ে হেলাল উদ্দিনের গ্রামের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের চির প্রতিদ্বন্দ্বী হুমায়ুন কবিরের গৃহিনী মিসেস নায়ার কবিরকে মেয়র পদে দল থেকে মনোনয়ন দিয়ে হুমায়ুন কবিরের সাথে পুনরায় সম্পর্ক তৈরি করেন। যদিও মিসেস নায়ার কবিরের মনোনয়ন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোনয়ন বলে একমাত্র নারী মেয়র হিসেবে প্রচারিত ছিল। হেলাল উদ্দিন পরবর্তীতে প্রয়াত এমপি এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু’র অনুসারী ও মোকতাদির চৌধুরীর রষানলে থাকা জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমানুল হক সেন্টু, শফিকুল আলম এমএসসি, মিনারা আলম, তাজ মো. ইয়াছিন ও সাবেক সচিব মিজানুর রহমানকে নিয়ে প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রকাশ্যে আসে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সনের নির্বাচন যেভাবে ছিনিয়ে নেন মোকতাদির: ২০১৪ সনের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামীলীগের এ আসনটি জাতীয় পার্টির সাথে চুক্তি অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর-৩ আসনে রেজাউল করিমকে দেয়া হলে মোকতাদির দিশেহারা হয়ে পড়েন। রেজাউল করিমকে জেলা ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী মাধ্যমে ভয় ও হুমকি দিলে রেজাউল করিম তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। তখন আওয়ামীলীগ থেকে মোকতাদিরকে পুনরায় নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়া হয়।

২০১৮ সনে বিএনপি নির্বাচনে গেলে এ আসনটিতে ধানের শীষের প্রতীক ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলকে মনোয়ন দেয়া হয়। সারা দেশের মত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও আওয়ামীলীগের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকলে এবং ইঞ্জিনিয়ার শ্যামলের ব্যক্তি ইমেজে ধরাশায়ী হতে থাকে মোকতাদির গং। ফলে আইনশৃংখলা বাহিনী দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল করতে থাকে। এছাড়াও বিএনপির মিছিলে ছাত্রলীগ দিয়ে একাধিক হামলা করার অভিযোগও রয়েছে। ফলে ৩০ ডিসেম্বর সারা দেশের মত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও দিনের ভোট রাতে ছাপানোর অভিযোগ উঠে। সেদিনের নির্বাচনে সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট ছাপানোয় বাঁধা দিলে মোকতাদিরের দেহরক্ষীর গুলিতে একজন বিএনপি কর্মীর মৃত্যু হয়। সেসময় মোকতাদিরের অনুসারী সাবেক ভিপি হাসান সারোয়ার ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শোভনের নেতৃত্বে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার শ্যামলের বাড়িতে হামলা করে বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

২০২৪ সনে বিএনপি নির্বাচনে না গেলে আওয়ামীলীগে এ টিম বি টিম নির্বাচনে প্রার্থী হয়। যা বিএনপির কাছে ডামি নির্বাচন নামে পরিচিত। সে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লায়ন ফিরোজুর ওলিও প্রার্থী হলে মোকতাদিরের ভয় বাড়তে থাকে। মোকতাদিরের এপিএস আবু মূসা আনসারি ওলিও’র মনোয়নপত্র ছিনতাই করার অভিযোগ উঠে। যার ফলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহগীর আলমকে জেলা থেকে বদলী করা হয়। নির্বাচনে মোকতাদির চৌধুরী নিজেকে একজন দুধ ব্যবসায়ী হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ২৪ এর নির্বাচনে ভোট ছাপিয়ে পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন মোকতাদির চৌধুরী। এবার তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী।

ছবি: সংগৃহিত

উপজেলা নির্বাচনে আধিপত্য: ২০১৪ সনে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাদের মাইনাস করে ঢাকার জুয়ারী জাহাঙ্গীর আলমকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেন মোকতাদির চৌধুরী। ২০১৯ সনে উপজেলা নির্বাচনে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভোটের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন তৃণমূলের ভোটে এডভোকেট মাহবুবুল আলম খোকন সর্বাধিক ভোট পেয়ে এগিয়ে থাকলেও মোকতাদির চৌধুরী পুনরায় জুয়ারী জাহাঙ্গীর আলমকে দলের মনোনয়ন দেন। দলের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা জানান, জাহাঙ্গীর আলম এক সময় মোকতাদির চৌধুরীর বাড়ির বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার থাকার সুবাদে তাকে দিয়ে নানান অনিয়মের কাজগুলো করতে পারে বলেই সিনিয়র ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদেরকে ডিঙিয়ে জাহাঙ্গীরকে পুনরায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন দেয় মোকতাদির। এই নির্বাচনে ঢাকার মদ ব্যবসায়ী ও সুলতানপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লায়ন ফিরোজুর রহমান ওলিও বেঁকে বসেন। তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের নেপথ্য সহযোগিতায় বিদ্রোহী হয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পার্থী ঘোষণা করেন। লায়ন ফিরোজুর রহমান ওলিও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা করানোর ফলে জনগণের ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

২০২৪ সনের নির্বাচনে লায়ন ফিরোজুর রহমান ওলিও উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার ঘোষণা দিলে মোকতাদির চৌধুরী বিপাকে পড়েন। জাতীয় নির্বাচনে ওলিও’কে ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এই নির্বাচনে আগের রাতে জেলার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে মোকতাদির চৌধুরীর হুশিয়ারিতে ভোট কারচুপির মাধ্যমে মোকতাদির চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে দুর্ব্যবহার: ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৯টি উপজেলায় ৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে। নাসিরনগর ১ আসন থেকে আওয়ামীলীগের প্রয়াত নেতা সাবেক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট ছায়েদুল হক, সরাইল-আশুগঞ্জ ২ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, কসবা-আখাউড়া ৪ আসনের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিছুল হক, নবীনগর ৫ আসনের সাবেক এমপি ফয়জুর রহমান বাদল ও বাঞ্ছারামপুর ৬ আসনের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজ এর সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করেন মোকতাদির চৌধুরী। সে দ্বন্দ্ব প্রতিফলন ঘটিয়ে তার একক আধিপত্যে অন্যান্য আসনের কোন এমপিকে জেলা শহরে প্রবেশ করতে দেয়নি মোকতাদির চৌধুরী।

২০১৬ সনে নবনিযুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জেলা পুলিশের ইফতার আয়োজনে আইনমন্ত্রী আনিছুল হককে প্রধান অতিথি করে আনলে মোকতাদির চৌধুরী ও পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের ওপর ক্ষীপ্ত হয় মোকতাদির। বিষয়টি আইনমন্ত্রী আনিছুল হক মোকতাদির চৌধুরী ও পুলিশ সুপারের দ্বন্দ্বটি মিমাংসা করেন। একই বছরে প্রয়াত নেতা এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু’র অনুসারীরা মেয়র হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুছ মাখন মুক্তমঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্যান্য আসনের সংসদ সদস্যদেরকে সংবর্ধনা দিয়ে তাদের গ্রুপটির সক্রিয়তা জানান দেন।

২০১৭ সনে স্বাধীনতা দিবসে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও তার অনুসারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্মৃতি শৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে গেলে জেলা ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে মারধর করার অভিযোগ উঠে।

২০২১ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা নির্বাচনে মোকতাদির এবং আল মামুন সরকারের দ্বৈত সিদ্ধান্তে মিসেস নায়ার কবিরকে পুনরায় দল থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিলে দলের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তখন বিদ্রোহী গ্রুপটি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী সভাপতি হাজী মাহমুদুল হক ভূইয়াকে নেপথ্যে সমর্থন দিয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেন। নির্বাচনে ভোট ছাপানো ও কারচুপির মাধ্যমে মিসেস নায়ার কবিরকে (পুতুল মেয়র) পুনরায় নির্বাচিত করান মোকতাদির চৌধুরী ও আল মামুন সরকার। এই নির্বাচনে দলের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মীরা মোকতাদির চৌধুরী ও আল মামুন সরকারের ওপর ক্ষীপ্ত হতে থাকে। পূর্বে আবদুল কুদ্দুছ মাখনের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ থাকার ফলে তাঁর নামটি মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে মুক্তমঞ্চ স্থানটি বঙ্গবন্ধু স্কয়ার নামকরণ করা হয় যা শহরের জনগণ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি।

মোকতাদিরের মুসলিম বিদ্বেষী: ২০১১ সনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মাদরাসার শিক্ষকদের ওপর ক্ষীপ্ততা প্রকাশ্যে আনেন মোকতাদির চৌধুরী। যেকোন বিষয়ে সভা-সমাবেশে মাদরাসা ও হুজুরদের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায় বক্তব্য দেন মোকতাদির চৌধুরী। এ যেন কুমিরের রচনা লেখার মত ঘটনা। ২০১৬ সনে ২৯ অক্টোবর জেলার নাসিরনগর ১ আসনের প্রয়াত সাবেক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হককে ফাঁসানোর জন্য মোকতাদির চৌধুরী ও আল মামুন সরকারের সাজানো রসরাজ নাটকের ঘটনায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধিয়ে মোকতাদির চৌধুরী বিদেশে পাড়ি জমান। সেখান থেকে উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মদ ব্যবসায়ী দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি’র নেতৃত্বে হিন্দুদের বাড়িঘরে ও মন্দিরে  হামলা চালায়। বিষয়টি জেলা সদরে অবস্থিত জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার ছাত্ররা প্রতিবাদ করলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাজী মাহমুদুল হক ভূইয়ার নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় এক ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হওয়ার পূর্বেই জেলা আইনশৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতায় সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মিমাংসা করেন। যদিও এর মাঝেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর আগুনের লেলিহানে পরিণত হয়। বিশ্ব বিখ্যাত সুর সম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল কার্যালয় পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি মিমাংসার পরে বিএনপি জামাত নেতাকর্মীদেরকে ঢালাওভাবে মামলায় আসামী করেন মোকতাদির।

২০২১ সনে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশে আগমণের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম শহরের রেল স্টেশন ভাংচুর করে। তারই প্রতিবাদ স্বরূপ পরের দিন ২৭ মার্চ বিকালে মোকতাদির ও মামুন গং শহরের জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় জমেত ছাত্রদের ওপর জেলা ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা চালায়। বিষয়টি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এক রণক্ষেত্র তৈরি হয়। পরের দিন ২৮ মার্চ শহরের বাহির থেকে লোকে লোকারণ্যে নাকাবন্দী হয়ে পড়ে সমগ্র শহর। আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে মাদরাসার ছাত্র ও জনতার মুখোমুখি লড়াইয়ে ১৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তবে শহরে আলোচিত আছে পৌর নির্বাচনে মোকতাদির ও মামুন গংয়ের একক আধিপত্য ধুলিস্যাত করতে আওয়ামীলীগের একটা অংশ শহরে জ্বালাও পোড়াও করেছে। তখনো বিএনপি জামাতের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলায় আসামী করে হয়রানী করার অভিযোগও উঠে।

চলবে…..