১৯৮৯ সনে পাক্ষিক ম্যাগাজিন “তারকালোক”এ আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতা মো. আবদুল মোহাইমেন’র লেখা থেকে চুম্বকাংশ তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ (মো. আবদুল মোহাইমেন)
(স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ কেন দেশ শাসনে ব্যর্থ হলো তার কারণ খুঁজেছেন একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগার, যিনি ১৯৪৯ সাল থেকে দলের একজন সদস্য এবং ১৯৭০ সালে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বিষয়ে লেখা তাঁর গ্রন্থটি নৈর্ব্যক্তিকতার কারণে প্রশংসিত, আবার অতি-আত্মসমালোচনার অভিযোগে বিতর্কিতও হয়েছেন।
ওই গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ এখানে প্রকাশ করা হলো।)
(১৯৮৯ সনের লেখানুযায়ী) ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবা স্বাধীন করেছে ১৯৫৮ সনে। সে আজ ২৫ বৎসরের পূর্বের ঘটনা হলেও ক্যাস্ট্রো এখনও সেতুং চীনের স্বাধীনতা এনেছিলেন ১৯৪৯ সনে। আজ ৩৪ বৎসর পরেও তাঁর মন ক্ষমতায় রয়েছে অপ্রতিহতভাবে। আলজিরিয়ার স্বাধীনতা এনেছিলেন বেনবেল্লা ও স্বায়ত্রী রামদিন ১৯৬৩ সনে। আজ কুড়ি বৎসর পরেও তাঁর দলই দেশ শাসন করছে নির্বিরোধিতায়। নিখিল পাকিস্তানের স্বাধীন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করল আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সনে কিন্তু সাড়ে তিন বৎসর যেতে না যেতেই তারা শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হলো না তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সপরিবারে নিহত হলেন। আওয়ামী লীগ জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের সমর্থন হারিয়ে আজ আরও দশটি সাধারণ রাজনৈতিক দলের মতো লক্ষ্যহীনভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সহসা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বা বিপ্লবের মারফত ক্ষমতায় আসার কোনো আশু সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
ফিদেল ক্যাংস্ট্রো, মাও সেতুং বা হুয়েরী বুমেদিন বা তাঁদের পার্টি আজও পূর্ণ জনসমর্থনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে কিন্তু আওয়ামী ঠিক এদের মতোই একটা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে এভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলো কেন? এবং শুধু ক্ষমতা থেকেই অপসারিত যে হয়েছে তাই নয়। সাধারণ মানুষ যারা আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ও তার প্রাক্কালে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল তাদের বেশির ভাগই আজ আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছে। আমেরিকা ও সিআইএ-র বদৌলতে এটা সম্ভব হয়েছে তবে উত্তরে বলা যায় যে আমেরিকা ও সিআই কিউবা ও চীনে ক্ষমতা দখলকারীদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা কম করেনি। সেখানে তাদের চেষ্টা সফল হলো না, এখানে হলো কেন? আওয়ামী লীগের সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনে আজ এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার ওপরই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন পুনঃ অর্জন সম্ভাবনা নির্ভর করছে।
১৯৬৬ সালে যখন ৬ দফা প্রোগ্রাম দেয়া হয় তখন থেকে আরম্ভ করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে ১৯৭১ সনে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীকাল ১৯৭২ সনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ জনপ্রিয়তা অটুট ছিল। কিন্তু তারপর এটা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৭৪ সনের শেষের দিকে এ জনপ্রিয়তা একেবারে সর্ব নিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় যখন আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ দেশের লোকের কাছে অযোগ্য দুর্নীতিবাজ ও আত্মকলহপ্রিয় একটি পার্টিতে প্রতিভাত হয়। ১৯৭১ সনে যে পার্টি লোকের কাছে এত প্রিয় এবং যার জন্য লোকে প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি সে পার্টির ওপর সাধারণ মানুষের আত্মা অনেকটা নষ্ট হয়ে যায় কেন এটা খুবই গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়।
স্বাধীনতার পর-পরই জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকে। দু’-বছরের মধ্যে ৬ আনার গামছা ৬ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। ১২/১৪ টাকার শাড়ি ৬০/৬৫ টাকায় গিয়ে পৌঁছে। নিত্য ব্যবরহার্য জিনিসের দাম হঠাৎ করে পাঁচ-সাত শুণ বেড়ে যায়। তার ফলে জনমনে স্থির বিশ্বাস জন্মে যে আওয়ামী লীগের অযোগ্যতা ও পার্টির কর্মীদের লুটপাটের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় দেশের ৯৭% লোক আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। এর মধ্যে চোর, ডাকাত, জুয়াচোর সবাই ছিল। তাই ১৯৭২ সালে ওই সব চোর, ডাকাত, জুয়াচোর প্রভৃতি যখন নিজ নিজ পেশায় ফিরে গিয়ে সমাজবিরোধী কাজ কর্ম করতে আরম্ভ করে দিল তখন তাদের অপকর্মের জন্যও লোকে আওয়ামী লীগকে দায়ী করতে আরম্ভ করল। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে দলীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজুদ্দীন সাহেব একের পর এক কতগুলি মারাত্মক ভুল করতে লাগলেন। স্বাধীনতার পর-পরই শেখ সাহেব একটা ভুল করলেন অথনৈতিক ক্ষেত্রে সেটা হলো তাড়াহুড়ো করে বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে সকল পাট ও বস্ত্রকল জাতীয়করণ করা।
জাতীয়করণ হলো সমাজতন্ত্রের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।কিন্তু এ পদক্ষেপকে কার্যকর ও সফল করার জন্য প্রয়োজন ছিল তিনটি অত্যাবশ্যকীয় শর্তের পূরণ। প্রথমটি হলো অত্যন্ত বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও সৎ রাজনৈতিক দল-এর নেতৃত্ব দেবে। দ্বিতীয়ত হাজার-হাজার শিক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বা ক্যাডার থাকবে এ প্রচেষ্টাকে সফল করার জন্য। তৃতীয়ত একটি সৎ বিশ্বস্ত প্রশাসন যন্ত্র থাকতে হবে সমস্ত পরিকল্পনাকে রূপ দানের জন্য। এই তিনটি শর্তের যে কোনো একটির অবর্তমানে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রচেষ্টা হিসেবে শিল্প জাতীয়করণ দেশের মানুষের মঙ্গলের চাইতে অমঙ্গলই বেশি করে। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ‘৭২ সনে যখন পাট ও বস্ত্র শিল্প জাতীয়করণ করা হয় তখন উপযুক্ত ক্যাডার তো ছিলই না বরং বিশ্বস্ত ও সৎ প্রশাসন যন্ত্রের সাহায্যও কতটুকু বিজ্ঞ, জ্ঞানী পাওয়া গিয়েছিল বলা কঠিন।
এতদ্ব্যতীত আওয়ামী লীগের তদানীন্তন নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সত্যিকার আগ্রহ কতটুকু ছিল এবং সমাজতন্ত্রের কতটুকু স্বচ্ছ ধারণা ছিল বলা শক্ত। ফলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এই তিনটি শর্তের প্রায় সবগুলিরই অবর্তমানে জাতীয়করণের উদ্দেশ্য সফল তো হয়ই নাই বরং এতদিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা বাণিজ্যের পদ্ধতিকে ভেঙে দিয়ে অল্পদিনেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হলো। জাতীয়করণ করার পর সে-সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালাবার মতো উপযুক্ত লোক পার্টি ক্যাডারে না থাকায় সেগুলোকে চালাবার জন্য ছেড়ে দেয়া হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ, অসাধু অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের হাতে। দু’দিনেই আরম্ভ হলো লুট।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যাডমিনিস্ট্রেটার, পারচেজ অফিসার, ম্যানেজারগণ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-নেতাদের যোগ সাজসে প্রায় প্রত্যেক শিল্প প্রতিষ্ঠানেই লুট করতে আরম্ভ করল। ফলে দফায়-দফায় জিনিসের দাম বাড়তে লাগল।
এক একটি পাটকল ও বস্ত্রকলে আড়াইগুণ শ্রমিক নিয়োজিত হলো। শ্রমিক ভর্তির ব্যাপারেও কারচুপির অন্ত রইল না। বহু স্থানে অস্তিত্বহীন শ্রমিকের নামে লক্ষ-লক্ষ টাকা মাহিনা নেয়া হতে লাগল। যন্ত্রাংশ কেনার প্রক্রিয়ায় কোটি-কোটি টাকা অপচয় হতে লাগল। সার্বিক অব্যবস্থার ফলে পাটের দর অসম্ভব কমে গেল। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। অল্পদিনেই বোঝা গেল ভারতে যেখানে পাটকলগুলি দক্ষ মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে সেখানে বাংলাদেশে পাটকলগুলি জাতীয়করণ করে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য পরিচালকদের দ্বারা পরিচালনা করা মস্ত বড় ভুল হয়েছে।
বিশ্ববাজারে আমরা বাজার হারাতে লাগলাম আর সে স্থান দখল করল ভারত। পাটকল জাতীয়করণ করার সময় এটা মোটেই খেয়াল করা হয়নি যে পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র পাট উৎপাদনকারী দেশ নই, আরো সাতটি দেশ পাট উৎপন্ন করে এবং তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের পাট বিক্রয় করতে হয়। বস্ত্রশিল্পের ব্যাপারেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তুলা কেনা ও সুতা বিক্রির মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা লুট হলো। জাতীয়করণকৃত বস্ত্রকলের এক একজন ম্যানেজারের গড়ে মাসিক আয় পঞ্চাশ হাজারে এসে দাঁড়াল। অধিকাংশ সুতা কালো বাজারের মারফৎ সরকারি মূল্যের ওপর বেল প্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকার অধিক মূল্যে তাঁতীদের হাতে পৌঁছাতে লাগল। বাড়লো তাঁতীদের দুর্গতি, জাতীয়করণ করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হলো।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তো হলোই না মাঝখান থেকে সমাজতন্ত্র মানে লুটপাট এই ধারণাই সাধারণ লোকের মনে বদ্ধমূল হালো। অবস্থা এমন হলো যে, ‘৭০/৭১’ সনে যেখানে সমাজতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষ পাগল ছিল সেখানে ৭৪/৭৫ সনে সমাজতন্ত্রের নামে কোনো কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ফলে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন কমপক্ষে ৫০ বৎসর পিছিয়ে গেল। অবস্থাটা বোধ হয় এরূপ করুণ হতো না যদি অবাঙালিদের পরিত্যক্ত মিলগুলিকে একটা করপোরেশনের অধীন করে বাঙালীদের মিলগুলিকে জাতীয়করণ এ স্বাভাবিকভাবে চলতে দেয়া হতো।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার্থে বাঙালি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মিলগুলির পরিচালনা বোর্ডে একজন শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়োগ বাধ্যতামূলক করে মুনাফার একটা নির্দিষ্ট অংশ শ্রমিকদিগকে দিতে হবে, এটা দিলেই সব চাইতে ভাল হাতো। মনে রাখা উচিত যে, ‘৪৯ সনে যখন চীন স্বাধীন হয় তখন দলে হাজার- হাজার শিক্ষিত ও নিষ্ঠাবান কর্মী থাকা সত্বেও চীনের কমিউনিস্ট সরকার দশ বৎসর চীনের শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত নিয়ন্ত্রণ করেনি। পুরাতন মালিকদেরই সরকারি নিয়ন্ত্রণে কারখানা চালাতে দেয়া হয়েছিল এবং দশ বৎসর পর যখন শিল্প কারখানা চালাবার মতো যথেষ্ট লোক পার্টিতে তৈরি হয় শুধু তখনই পুরাতন মালিকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আমাদের এখানেও যদি অনুরূপ নীতি অনুসৃত হতো তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এতবড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন আমরা হতাম না এবং অর্থনীতি ধ্বংসের নিন্দারও ভাগী হতাম না। বাঙালীদের বস্ত্রকলগুলি যদি জাতীয়করণ না করা হতো তবে গত ১২ বৎসরে সুতার দামের এত অধিক বৃদ্ধি হতো না। ৭৫ সন পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে এমন কোন বৎসর যায়নি যে বৎসরে অন্তত একবার সুতার দাম বাড়ানো হয়নি। কোনো-কোনো বৎসরে দু’বারও বাড়ান হয়েছিল।
এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৮২ সনের শেষ পর্যন্ত। প্রতি বৎসরই নানা অজুহাতে বিটিএমসি সূতার দাম দু’-তিনবার বাড়িয়েছে। অথচ ১৯৮২ সনের শেষ দিকে যখন বাঙালিদের মিলগুলি পুরাতন মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হলো তারপর থেকে গত এক বৎসরের মধ্যে বিটিএমসি মিল মালিক কেউই সুতার দাম বাড়ায়নি। যতদুর শোনা যায় সুতার দাম না বাড়িয়েও মিল মালিকরা কয়েক বৎসর পূর্বে প্রচুর মুনাফা অর্জন করছে। মিল মালিকেরা তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন যে, যদি তাঁদেরকে মিল ফিরিয়ে দেয়া হয় তবে তারা তখনই তৎকালীন শতকরা ২৫ ভাগ কম দরে সুতা বিক্রি করতে রাজি আছেন।
সে সময় মিলগুলি ফিরিয়ে দিলে বর্তমানে সুতার দাম যা আছে তার চাইতে অনেক কম থাকত। অসময়ে জুটমিল ও কটনমিলগুলি জাতীয়করণ করার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা আলোচনা করেছি। কিন্তু বর্তমানে পানির দরে সরকার জাতীয়করণকৃত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিক্রি করে দিচ্ছেন তা-ও কোনভাবে সমর্থন করা যায় না। স্বাধীনতার পর “৮১/৮২” সন পর্যন্ত গত দশ-বারো বছর বৎসরে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগত লোকসান হতে থাকলেও এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে উৎপাদন বণ্টন ও পরিচালনার ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মারফত অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানই শেষ পর্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়া আর কিছুদিন চললে পরিচালক ও কর্মচারীদের সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি আরো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো এটা নিশ্চিত যার ফলে শেষ পর্যন্ত দেশ, জাতি ও জনসাধারণ উপকৃত হতো।
কিন্তু ঠিক এই সময়ে এগুলিকে পানির দামে কতিপয় শিল্পপতি, ১৯৭২ সন পর্যন্ত শিল্পপতি হিসেবে বাজারে যাদের কোনো পরিচয়ই ছিল না এবং পরিচালনা ব্যাপারেও যাদের জ্ঞানী দক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়, তাদের কাছে এ সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি। যারা এসব প্রতিষ্ঠান কিনেছেন তাঁদের অধিকাংশই গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আমদানী ব্যবসার মারফত এবং শিল্প পরিচালনার ব্যাপারে যাঁদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান কেনার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকমত চালাতে পারছেন না, ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কেনার সময় কোনোভাবেই শ্রমিক ছাঁটাই করবে না বলে সরকারকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা রক্ষা করছে না এবং সরকারকে দেয় বাকি টাকাও দিতে পারছে না।
ফলে সমগ্র শিল্প জগতে একটা অস্বাভাবিক ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

‘৭২ সনে পাট ও বস্ত্রকল জাতীয়করণ করা যদি আমাদের ভুল হয়েছিল এ সিদ্ধান্তে আসা যায় তবে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে বর্তমানে বিরাষ্ট্রীয়কৃত পাট ও বস্ত্রকলগুলি আবার জাতীয়করণ করা হবে এ ধরনের উক্তি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর হচ্ছে বলে মনে হয়। এর ফলে বাঙালি উদীয়মান শিল্পপতি যারা’৭২ সনের পূর্বের অবাঙালিদের শোষণের বাঙালিদেরকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে একতাবদ্ধ করতে নানাভাবে সাহায্য করেছিল তাদেরকে অহেতুক আতঙ্কিত করে তোলা হয়। আরো একটা কথা বিবেচনা করতে হবে-মার্ক্সীয় দর্শন অনুযায়ী পুঁজিবাদের চরম পূর্ণতা লাভ সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশ সামন্ততন্ত্র ছেড়ে সবেমাত্র পুঁজিবাদে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, এর পূর্ণতা আসতে এখনো অনেক বিলম্ব। সময় উপযুক্ত হওয়ার আগে ইচ্ছা করলেই কাঁঠালকে পিটিয়ে পাকানো যায় না। তাই ক্ষমতায় এলে আবার সব পাট ও বস্ত্রশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করে ফেলব এসব কথা বাস্তবধর্মী নয়। এতে শ্রমিক ফ্রন্টে কিছুটা আপাতত জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় কিন্তু তাতে সুদুরপ্রসারী কোনো লাভ হয় না।
শেখ সাহেব করে গেছেন তাই যুক্তিতে না টিকলেও তাকে বহাল রাখতে হবে এটা কোনো সুস্থ মনের পরিচয় বহন করে না। শেখ সাহেব মানুষ ছিলেন, ফেরেশতা ছিলেন না। তাঁর ভুল-ভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। শেখ সাহেব মানুষ হিসেবে যত বড় হোন না কেন চীনের মাও সেতুং-এর চেয়ে বড় ছিলেন না। মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর তাঁর মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর নিজ হাতে বলেছে, ‘মাও ছাড়া নতুন চীনের কথা কল্পনা করাই যায় না। নতুন চীনের জন্য চীনের মানুষ তাঁর কাছে অশেষ ঋণী তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে ভুল হয়েছিল। এতে চীনের বিশেষ ক্ষতি হয়েছে। এতে দেখা যায়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা অনেক বাস্তবধর্মী।
শেখ সাহেব কোনো ভুল করতে পারেন না, তাকে সমালোচনা করা যাবে না, এমন মনোভাব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নেতারা যেরূপ বিবেক বুদ্ধি বন্ধক নিয়েছেন, চীন এরূপ কোনো ভুল করেনি। বাংলাদেশ হওয়ার কিছুদিন পরেই অর্থমন্ত্রী তাজুদ্দীন সাহেবের পাকিস্তানী ও ভারতীয় নোট বদলে নেয়ার সময় সম্পর্কে গৃহীত নীতি মানুষের মনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করে। পাকিস্তানী নোট বদলে নেয়ার জন্য মাত্র ৫ দিন সময় দেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় নোট বদলে নেয়ার জন্য প্রথমে ১ মাস ও পরে আরো ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশি ও ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য সুই সমান ছিল। তার প্রজাতে বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম ধীরে কমতে আরম্ভ করে। মাস ছয়েক পরে বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্য দুই-তিন মাস সমান ছিল।
তার পরে বাজারে বাংলাদেশি মুদ্রার দাম ধীরে ধীরে কমতে আরম্ভ করে। মাস ছয়েক পরে বাংলাদেশি মুদ্রারমূল্য ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় দ্রুত হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর-পরই ভারত থেকে আমাদের প্রথম কিস্তির কারেন্সী নোট ছাপিয়ে আনা হয়। গুজব রটে গেল যে আমাদের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেয়ার জন্য ভারত ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে পরিমাণ নোট বাংলাদেশ সরকার ছাপতে দিয়েছিলেন তার দ্বিগুণ নোট ছেপে বাজারে ছেড়েছে। আমাদের টাকার মূল্য হঠাৎ দ্রুত কমে যাওয়ায় এবং এ সময় দুই একটি একই নম্বরের এক টাকার নোট বাজারে পাওয়া যাওয়ায় (সেগুলির বিবরণ ফটোসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিলে) উক্ত গুজবে মানুষ আস্থা স্থাপন করতে আরম্ভ করল।
আমাদের টাকার মূল্য কমে যাওয়ার ফলে জিনিসের দামও হু-হু করে বেড়ে যেতে আরম্ভ করল। এতে মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনেক বেড়ে গেল এবং এসব কিছুর জন্য সাধারণ মানুষ ভারতের ডবল নোট ছাপার কল্পিত ঘটনাকে দায়ী করতে আরম্ভ করল। এ সময় মানুষ চেয়েছিল যথা শীঘ্র ভারতীয় নোট যেন জমা পড়তে না পেরে অচল ঘোষিত হয়। কিন্তু ভারতীয় নোটের বদলের সময় সীমা যখন প্রথমে এক মাস দেয়া হলো তখনই দেশব্যাপী একটা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। লোকে মনে করতে আরম্ভ করল আওয়ামী লীগের বহু নেতা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতে ছিলেন তাদের সম্ভবত লক্ষ-লক্ষ টাকা ভারতে রয়েছে, সেগুলি এবং বড়-বড় মারোয়াড়ীদের হাতে বাংলাদেশের যে সব টাকা রয়েছে সেগুলি বদল করে নেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যই এত দীর্ঘ সময় দেয়া হয়েছে। এতে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রীর ওপর দেশের মানুষ সাধারণভাবেই ক্ষেপে গেল এবং আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তাও এতে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
তাজুদ্দীন সাহেবকে তার দু’একজন ঘনিষ্ট বন্ধু এই সময়ের স্বল্পতা ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্ত দেন যে, পাকিস্তানের টাকার ব্যাপারটা হলো ডিমনিটাইজেশন আর ভারতের টাকার ব্যাপারটা হলো প্রত্যাহার বা উইথড্রয়ার। প্রথমটা হলো নির্দিষ্ট তারিখের পর অচল ঘোষণা, পরেরটা হলো ভারতীয় সমস্ত টাকা প্রত্যাহার করে নেয়া। তিনি বললেন ভারত থেকে মোট ৩৫০ কোটি টাকার নোট ছাপা হয়েছে। সত্যিই ভারত নির্দেশিত ৩৫০ কোটি টাকার বেশি নোট ছেপে বাজারে চেড়েছে কি-না সেটা আমি জানতে চাই। লম্বা সময় দিল যাতে সমস্ত নোট জমা হতে পারে এবং আমরা প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারি সাড়ে তিন শত কোটি টাকার বেশি নোট জমা হলেই আমরা ভারত সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারব।
একই নম্বরের দুটি নোট ছাপার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, আমাদের বিদেশি মুদ্রা না থাকায় প্রথম কিস্তির নোট বাধ্য হয়েই ভারত থেকে বাকিতে ছাপাতে হয়েছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত ছাপাতে গিয়ে নম্বর মেশিন না ঘুরার ফলে দু’এক ক্ষেত্রে একই নম্বরের নোট বেরিয়ে পড়েছে। লক্ষণীয় যে এক টাকার নোটের সংখ্যা বিপুল পরিমাণ হওয়ায় ক্রুটি শুধু ওই নোটের ক্ষেত্রেই হয়েছে। জনমনে বিভ্রান্তি দূর করণার্থে ভারতের নোট প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে অধিক সময় দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রেস নোট উস্যু করতে অনুরোধ করলে তাজুদ্দীন সাহেব অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেন, কতকগুলি সাধারণ মানুষ কী বলে বা ভাবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে তিনি রাজি নন। চিলে কান নিয়ে গেছে বললে চিলের পিছনে দৌড়াতে হবে নাকি?
সরকার পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা না দেয়ার ফলে উপরিউক্ত গুজবকে লোকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাজুদ্দীন সাহেবকে ভারতের দালাল বলে অভিহিত করতে লাগল। যে তাজুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল এবং যাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, ‘৭২ সালে প্রথম দিকেও যিনি এদেশের সর্বশ্রেণির মানুষের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র (শেখ সাহেব মানুষ ছিলেন, ফেরেশতা ছিলেন না। তাঁর ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। শেখ সাহেব মানুষ হিসেবে যত বড় জ্ঞানী হন না কেন চীনের মাও সেতুং-এর চেয়ে বড় ছিলেন না। শেখ সাহেব কোনো ভুল করতে পারেন না, তাঁকে সমালোচনা করা যাবে না এরূপ মনোভাব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের নেতারা যেরূপ বিবেক-বুদ্ধি বন্ধক দিয়েছেন, চীন এরূপ কোনো ভুল করেনি।)
ছিলেন এই নোটের ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে তিনি রাতারাতি অত্যন্ত নিন্দার ও সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়লেন। এটা সত্যিই অত্যন্ত সুঃখজনক ব্যাপার। তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। হয়তো ব্যাখ্যা দিয়ে প্রেস নোট ইস্যু করলে লোকের সন্দেহ অনেকটা কেটে যেত কিন্তু একগুঁয়েমি করে সাধারণ লোকের মনোভাবের কোনো মূল্য না দেয়ার ফলে মৃত্যুর কাছে ভারতীয় দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। এ কারণেই শেখ সাহেব যখন তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করলেন দেশের কোথাও কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না। বরখাস্তে দেশের কোথাও প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও আওয়ামী লীগের কর্মী মহলে শেখ সাহেবের এ কাজটি দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। দেশবাসী যাই ভাবুক আওয়ামী লীগ কর্মীরা কিন্তু তাজুদ্দীন সাহেবকে অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগ পার্টিতে অনেক নেতার চাইতে ভাল লেখাপড়া জানা ও জ্ঞানী লোক বলে মনে করত। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বিভিন্ন প্রাণ সম্পর্কে তাঁর যত স্পষ্ট ধারণা ছিল অন্যদের এত স্বচ্ছ ধারণা ছিল কি না সন্দেহ। পার্টিতে জ্ঞান প্রজ্ঞার দিক থেকে তিনি ছিলেন শেখ সাহেবের ডান হাত, এটাই ছিল কর্মীদের ধারণা।
তাই রাজনৈতিকভাবে তাঁকে ধ্বংস করতে গিয়ে শেখ সাহেব বোধ হয় সে ডান হাত নিজেই ভেঙে দিয়ে নিজের ও পার্টির অসম্ভব ক্ষতি করেছিলেন বলে অনেকে মনে করে। যাহোক ভারতীয় নোট প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সমাপ্তি টেনে প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা উচিৎ যে নোট প্রত্যাহত হওয়ার কয়েক মাস পর যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব পত্রিকায় বের হলো তখন দেখা গেল ভারত থেকে মুদ্রিত ৩৫০ কোটি টাকার মধ্যে সম্পূর্ণ টাকা জমা হয় নাই। ৪০ লাখ টাকা কম জমা হয়েছে। তাতে পরিষ্কার প্রমাণ হলো দ্বিগুণ টাকা ছাপা হওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গুজব। শেষ পর্যন্ত সত্য প্রকাশিত হলেও তাজুদ্দীন সাহেব রাজনৈতিকভাবে শেষ হয়ে গেলেন এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাও প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
এর পূর্বে তাজুদ্দীন সাহেব বর্ডার ট্রেড বা সীমান্ত ব্যবসা সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যেটা শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে অশেষ ক্ষতির কারণ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর-পরই ভারত ও বাংলাদেশের দশ মাইলের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থ চালু হয়। যে কোনো লোক ভারত বা বাংলাদেশ থেকে স্ব-স্ব দেশের সীমান্তের শুল্ক ঘাটিতে শুল্ক জমা দিয়ে যে কোনো মাল নিয়ে দশ মাইলের মধ্যে বেচাকেনা করতে পারত। এভাবে অবাধ বাণিজ্যের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন এমনিতেই তো কোটি-কোটি টাকার মালপত্র এপার ওপারে চোরাচালান হয় এবং তাতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার কেউ শুল্ক পায় না। নতুন ব্যবস্থায় ওই মালই শুল্ক ঘাটিতে শুল্ক দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাতে দুই সরকারী রাজস্ব পাবে। বিএসএফ-এর লোককে ঘুষ নিয়ে সীমান্ত পার করতে হতো। এখন আইনসিদ্ধভাবে নিতে পারবে বলে লোক শুল্ক দিয়ে নেয়াই বাঞ্ছনীয় মনে করবে।

ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা আছে এরকম বন্ধু মানুষ দু’চারজন তাকে বললেন যে অধিকাংশ লোকই তার বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরের শুল্ক ঘাটিতে মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রকার আগ্রহ না দেখিয়ে সোজা সীমান্ত পার হয়ে মাল বেচে নিয়ে আসবে। তাতে পূর্বে নানা প্রকার বাধা বিপত্তি থাকার ফলে যে পরিমাণ মাল চোরাচালানের মারফত দেশের বাইরে যেত এখন তার চাইতে অনেক বেশি মাল দেশের বাইরে চলে যাবে এবং কোনো শুল্ক বাংলাদেশ সরকার পাবে না। এই মতের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী এক হলেন না। বরং এই মন্তব্যের দ্বারা বাংলাদেশের সদ্য স্বাধীন হওয়া মানুষদের দেশপ্রেমের প্রতি কটাক্ষ করা হচ্ছে বলে মনে করলেন। ওপেন বর্ডার ট্রেড আরম্ভ হলো এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়েছে দেখা গেল। সীমান্ত শুল্ক ঘাটিতে এক পয়সাও জমা হলো না।
এদিকে লক্ষ-লক্ষ মণ ধান, চাল ও পাট সীমান্তে অতিক্রম করে ভারতে চলে গেল। বাধা বিপত্তির ফলে পূর্বে যে পরিযাণ মাল সীমান্ত অতিক্রম করত এখন তার দশ বিশ গুণ মাল বাইরে চলে গেল। এই বর্ডার ট্রেডের ব্যাপারটি এক বৎসরের মেয়াদের জন্য দু’দেশের চুক্তি হয়েছিল। এক বৎসর মেয়াদ পার হওয়ার বহু পূর্বেই বাংলাদেশ সরকার এর ক্ষতিকর দিকটা ভালভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে কিছু করণীয় ছিল না। যাহোক এক বৎসর পার হওয়ার পর সীমান্ত বাণিজ্যের চুক্তি নবায়ন না করে বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা এর মধ্যে হয়ে গিয়েছে। ‘৭১ সনে অনুকূল আবহাওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলা সত্ত্বেও এ দেশে প্রচুর পরিমাণ ধান হয়েছিল। তখন এদেশে চালের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মণ।
উন্মুক্ত সীমান্তে বাণিজ্যের ফলে লক্ষ-লক্ষ মণ ধান, চাল ভারতে চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যেই চল্লিশ টাকা মণের চাল একশত টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে দেশের মানুষের মনে হতাশা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যেটা আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে মোটেই সুখের ছিল না।সীমান্ত বাণিজ্যের সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি যতদূর সম্ভব অর্থনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রসূত ছিল মনে হয়। এটা একটা অনিচ্ছাকৃত ভুলই হয়েছিল বলা চলে।

(জনমনে বিভ্রান্তি দূর করণার্থে ভারতের নোট প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে অধিক সময় দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রেস নোট ইস্যু করতে অনুরোধ করলে তাজুদ্দীন সাহেব অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেন, কতকগুলি সাধারণ মানুষ কী বলে বা ভাবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে তিনি রাজি নন!)
আওয়ামী লীগ চীন বা ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির মতো আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। পশ্চিমারা সব লুটে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের শোষণের ফলেই আমাদের যাবতীয় সব সম্পত্তির মালিক আমরা হব এরূপ একটা অদ্ভুত ও অযৌক্তিক ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অধিকাংশ কর্মী এই রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেয়। এর মধ্যে সত্যিকারের আদর্শনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক কর্মী যে একেবারে ছিল না তা নয়। তবে তাদের সংখ্যা ছিল খুব কম।৬ দফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন ও আগরতলা কেসের ফলশ্রুতিতে ১৯৬৭/৬৮ সনে যখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে আরম্ভ করল অফিসে গেলে দেখা যেত চেয়ার দখল করে আছে যত নতুন নতুন মুখ। পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্মীরা বসার চেয়ার পর্যন্ত পেত না। অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।
তখন অনেকেই পার্টিতে কার্ড সিস্টেম দ্বারা কর্মীদের অতীত সার্ভিসের রেকর্ড পাওয়া যেত এবং কে কতদিনের কর্মী তা জানা যেত, তা চালু করার জন্য বারবার অনুরোধ করেছিল। দলীয় অনেক নেতা বিশেষ করে পার্টি প্রধান এটাকে মোটেই গুরুত্ব দেননি। ফলে সুবিধাবাদী, চরিত্রহীন বহু লোক আওয়ামী লীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে যত্রতত্র লুট আরম্ভ করে দিল। ১৯৭৩ সনে তেলের দাম বাড়ার ফলে পৃথিবীব্যাপী জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নামে কতকগুলী লোকের অবাধ চুরি ও লুণ্ঠন অবস্থাকে আরো সঙ্গীন করে তুলল। এ সময় কঠিন হাতে প্রথম থেকেই বন্ধ করা উচিত হাতে ছিল। কিন্ত কর্মীদের প্রতি শেখ মুজিবের অপরিসীম মমতার ফলে বা নিজের মানসিক দুর্বলতার ফলে দৃষ্টান্তমূলক অপরাধের জন্য শক্ত হাতে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। চারদিকে যখন প্রচণ্ড অরাজকতা ও লুটপাট চলছিল তখন তা কঠিন হস্তে দমন করার জন্য পার্টির কোনো-কোনো মহল থেকে শেখ সাহেবকে শক্ত হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানান হয়, গ্রেপ্তারকৃত লোকেরা আওয়ামী লীগের কর্মী বা কর্মীর আত্মীয় হলেও তাকে কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্য চারদিক থেকে দাবি উত্থাপিত হতে থাকে।
‘৭২ সনের শেষ দিকে যখন সিগারেট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দুষ্প্রাপ্যতার সুযোগ নিয়ে কালোবাজার দেশব্যাপী হঠাৎ জেকে বসে। তখন পুলিশ দিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকা ঘিরে তল্লাশি চালানোর ফলে জনৈক ছাত্রনেতার বাসভবন থেকে ৯ লক্ষ টাকার সিগারেট পাওয়া যায়। এ ঘটনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া সত্বেও উক্ত নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘৭২ সনে দেশে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত তেমন লুটপাট আরম্ভ হয়নি। অল্প কিছু লোক যারা প্রথম থেকেই পেশাগতভাবে লুটেরা ছিল শুধু তারাই লুটপাট আরম্ভ করে। ছাত্র ও সাধারণ যুবক সম্প্রদায় যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে কমবেশি প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বেশ কিছুটা দেশাত্মবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকার ফলে তারা লুটপাটে যোগ দেয়নি। কিন্তু কয়েক মাস পরে যখন তারা দেখল যে লুটের জন্য শাস্তি তো হচ্ছেই না বরং লুটলব্ধ অর্থের বলে লুটেরাই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও পার্টিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে তখন আদর্শনিষ্ঠ প্রায় সব যুবক ও কর্মীর মনোবল ভেঙে গেল। তার ফলে আরম্ভ হলো দেশব্যাপী লুটের মারফত ভাগ্য পরিবর্তনের উন্মত্ত প্রয়াস।প্রথম থেকে যদি দোষী ব্যক্তিদের নির্মম হস্তে দমন করা হোত তবে দেশের ইতিহাসই অন্য রকম হতো মনে হতো।
যতদূর মনে পড়ে “৭৩ সনের শেষভাগে লুটপাট ও কালোবাজারী বন্ধের জন্য শেখ সাহেব দেশব্যাপী সৈন্য নামিয়ে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক আর্মি অপারেশনের ফলে দেশের বহু জায়গায় জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ কমে গিয়েছিল। কিন্তু যতদূর জানা যায় আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতৃস্থানীয় নেতা বিপদগ্রস্ত হওয়ায় তাদের চাপে তিনি সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করেন। এর ফলে শুধু যে শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা অনেকটা ক্ষুণ্ন হলো তাই নয় সৈন্য বাহিনীর লোকের মধ্যেও তাদের আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে না দেয়ার কারণে দারুণ অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। এ সময় দুর্নীতি ও কালোবাজারীর একটি ঘটনা সমস্ত দেশব্যাপী দারুণ চাঞ্চল্য ও সমালোচনার সৃষ্টি করে। সেটি হলো কুমিল্লার কসবা এলাকার এক মহিলা এমপি-র বাড়িতে রিলিফের কয়েক হাজার শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল ও কয়েকশতদুধের টিন উদ্ধার হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি সামরিক বাহিনীর একজন অতি উচ্চ পদস্থ অফিসার ও কুমিল্লার ডিসি-র সম্মুখে হয় এবং কয়েক দিন যাবত বিভিন্ন পত্রিকায় দারুণ সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। দেশবাসী মনে করে যে এবার একজন দোষীকে যখন হাতে নাতে ধরতে পারা গেছে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে একটা দুষ্টান্ত স্থাপন করা হবে। অতি আশ্চর্যের বিষয় আওয়ামী লীগের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীকে হতাশ করে দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটাকে শেষ পর্যন্ত ধামা চাপা দেয়া হলো।
এতে আওয়ামী লীগ ও শেক সাহেবের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শোনা যায় এ সুন্দরী মহিলা এমপি শেখ ফজলুল হক মনির মুখ স্নেহভাজন ছিল বলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও শেখ সাহেব এ ব্যাপারে কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি।
“৭৩ সনের মাঝামাঝি যখন বেবী ফুডের দারুণ অভাব ও কালোবাজারী আরম্ভ হয়েছিল তখন হঠাৎ মৌলভীবাজারের ১৩ জন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয় যেটা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। দুর্নীতি দমনে শেখ সাহেব হচ্ছেন মনে করে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী ও কর্মীদের মধ্যে একটা উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই গ্রেফতারকৃত ব্যবসায়ীরা ছাড়া পেয়ে গেল এবং কেন তাদেরকে ছাড়া হলো সরকার কোনো প্রেসানার্টেও ইস্যু করল না। এর ফলে দেশের লোকের মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো যে এই সব কালোবাজারীরা নানা সূত্রে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বা আত্মীয়তা সূত্রে জড়িত। তাই অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ সাহেব তদন্ত করে শাস্তি দেয়ার জন্য নির্মম ও কঠোর হতে পারেননি তার কারণ বোধ হয় তিনি জীবনে কখনো বিপ্লবী পার্টির লোক ছিলেন না।
বিপ্লবীরা প্রয়েঅজনে নির্মম নিষ্ঠুর হতে পারে, এ শিক্ষা তাদেরকে প্রথম থেকেই দেয়া হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য দু’চার পাঁচ জনকে প্রয়োজন হলে শত-শত লোককে হত্যঅ করতে তারা ইতস্তত করে না। কিন্তু শেখ সাহেব ছিলেন অন্য ধরনের মানুষ। নিজে তিনি অত্যন্ত সাহসী পুরুষ হলেও মনটা ছিল তার অত্যন্ত কোমল। একবার টেলিভিশনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, কোন লোক খুন করে এসে তার পা ধরে মাফ চাইলে তিনি মাফ করে দেন। তিনি নিজে বিপ্লবী ছিলেন না এবং বিপ্লবের শিক্ষাও তাঁর ছিল না। তাই রক্তাক্ত সংগ্রামের মারফত যে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাকে পরিচালনার জন্য যে দক্ষতা, যে কঠোরতাও বিপ্লবী জ্ঞানে প্রয়োজন ছিল তা তাঁর ছিল না। দেশে লুটপাট যখন চরম অবস্থায় চলছিল তখন তার জনৈক বন্ধু তাঁকে বলেছিলেন যে স্বাধীনতার জন্য যদি ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়ে থাকে তবে বাকি লোকের নিরাপত্তা জন্য তাঁকে আরো পঞ্চাশেক লোককে গুলি করে মারার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে সর্বমোট জন পঞ্চাশেক কালোবাজারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই দেশে লুটপাট অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে।
শেখ সাহেব তাঁর বন্ধুর কথা শুনে আঁৎকে উঠে বলেন “ভাই আপনি জানেন না, বাঙালিদের গুলি করলে হিতে বিপরীত হয়’। বন্ধুটি বুঝলেন শেখ সাহেব এখনো মনের দিক থেকে ১৯৫২ সনে বাস করছেন। সে বৎসর নূরুল আমিন সাহেব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় দু’টি ছেলেক গুলি গদি হারিয়েছিলেন। তাই শেখ সাহেব মনে করেছেন এখনো তাই হবে।
‘৫২ সন আর ৭২ সনের মধ্যে এদেশের মানুষের মানসিকতায় যে কত পরিবর্তন হয়েছে সেকথা তিনি যেন অনুভবই করতে পারছিলেন না। এদেশের জ্ঞানী গুণীজনের অধিকাংশের মতে সত্যিই ৭২ সনের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে কালোবাজারী ও লুটপাটের জন্য যদি গোটা পঞ্চাশেক লোককে ঝুলিয়ে দেয়া যেত তবে এদেশের ইতিহাসই অন্যরকম হতো। কিন্তু শেখ সাহেব তাঁর কর্মীদের প্রতি অপরিসীম মমতা ও স্নেহের জন্য কঠোর হতে দ্বিধা করে দেশকে অনিচ্ছা সত্বেও সম্ভাব্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
‘৭২ সনের মাঝামাঝি লুটপাট, লোভ লালসা বাঙালি যুবকদের চরিত্র যতটা না অধঃপতন ঘটাতে পেরেছিল তার চাইতে বেশি অধঃপতন ঘটাতে পেরেছিল যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে সাহায্যের নামে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ-লক্ষ প্যান্ট ও শার্ট পিস সাহায্য হিসেবে এদেশে আসে যেগুলি পর্যায়ক্রমে এদেশের স্কুল-কলেজগুলিতে বিলি করা হয়।

(‘৭২ সনের শেষ দিকে সিগারেট ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দুষ্প্রাপ্যতার সময় জনৈক ছাত্রনেতার বাড়িতে ৯ লক্ষ টাকার সিগারেট পাওয়া যায়… তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।)
প্রায় ক্ষেত্রেই এক একটি ছেলে এই দেড় দুই বৎসরের মধ্যে দুই-তিন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার-পাঁচবারও শার্ট প্যান্ট পিস পায়। শহরের স্কুল কলেজের ছেলেরা যেগুলি পেয়েছিল সেগুলি মোটামুটি নিজেরা ব্যবহার করেছে, কিন্তু গ্রামের স্কুলের ছেলেরা যেগুলি পেয়েছিল তা অধিকাংশ বিক্রি করে দিয়েছিল। এগুলি বেশির ভাগই কালোবাজারিদের হাত হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে চলে যায়।
বিদেশ থেকে পাওয়া এসব প্যান্ট পিস স্কুল কলেজের ছেলেদের মধ্যে যথেচ্ছা বিলির ফলে যে সব মারাত্মক কুফল দেখা গেছে তার মধ্যে একটা হলো প্রয়োজন না থাকলেও অতি অল্প মূল্যে কখনো কখনো বিনা মূল্যে যতগুলি সম্ভব শার্ট ও প্যান্ট পিস্ হস্তগত করার জন্য যে কোনো অসাধু পন্থা অবলম্বন করার প্রচেষ্টা। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে স্কুলগুলিতে যেদিন কাপড় বিলি হয়েছে সেদিন গেটের বাইরে কাপড় ব্যবসায়ীদের লোকেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাত্রদের হাতে কাপড় পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাপড় হাত বদল হয়ে গেল। এভাবে সাহায্যের নামে আসা বার আনা কাপড় দেশের বাইরে চলে যায়। মাঝে থেকে এদেশের এতদিনের নিষ্পাপ ছেলেরা কালোবাজারিতে প্রথম হাতে খড়ি পেল।
শহরের স্কুলগুলোর ছেলেরাও যারা বৎসরে দু’টি প্যান্ট দিয়েই চালিযে দিত তারাও যখন নতুন নতুন ডিজাইন ও নানান রঙের চার পাঁচটি প্যান্ট পিস্ পেল, প্রয়োজন না থাকলেও সেগুলি ব্যবহার করার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। ফলে ছেলেরা একদিকে যেমন হয়ে পড়ল বিলাসের প্রতি আসক্ত তেমনি সেলাই খরচ দিতে গিয়ে অভিভাবকেরা হয়ে পড়ল সর্বশান্ত।
‘৭২/৭৩’ সনে যেকোনো দর্জির দোকানে গেলে দেখা যেত দোকানগুলো দু’তিন মাসের মধ্যে কোনো অর্ডার নিতে অক্ষম। সাহায্যপ্রাপ্ত প্যান্ট ও শার্টের অর্ডারে সবাই বুকড। স্বাধীনতার পর-পরই বিদেশি সাহায্যে কাপড়, দুধ, ঢেউ টিন, নগদ অর্থ প্রভৃতির বণ্টন সমস্যা নিয়ে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারকে দারুণ জটিল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। যাদের হাতে বণ্টনের দায়িত্ব ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অসাধুতার ফলে বেশির ভাগ দ্রব্যই অভাবী লোকদের হাতে না পড়ে নেতাদের সচ্চল আত্মীয় স্বজনের হাতে পড়তে লাগল। এসব রিলিফের মাল যাদের হাতে পড়ল তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আংশিক ব্যবহার করে বাকিটা কালোবাজারে বিক্রি করে দিতে আরম্ভ করল।
এই রিলিফের মাল বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন জেলায়, থানায় কর্মী ও বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক কোন্দল ও রেষারেষি এক মর্মান্তিক দুঃখজনক পর্যায়ে পৌঁছে। রিলিফের মাল বেচে ভাগ্য পরিবর্তনের নেশা যেন প্রত্যেককে পেয়ে বসে।
নিজেদের মধ্যে কোন্দল হানাহানি এবং তৎকারণে সমগ্র পার্টিকের লোক চক্ষে হেয় হয়ে যাওয়ার এসব কিছু ঘটনা যদি প্যান্ট পিস্ ও শার্টের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিতেন যে বিদেশ থেকে যত কাপড়ই আসুক না কেন তা এক রঙের এবং এক ডিজাইনের হতে হবে। তার পরও বলে দেয়া যেতে পারত যে, বাংলাদেশের সাহায্য হিসেবে প্রেরিত কাপড়ের প্রত্যেক এক গজ বা দুই গজ বা দুই গজ পর পরই বাংলাদেশের আদ্যাক্ষরটি ছাপা থাকবে। এটা হলে কোনো ছেলেই নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া একটির বেশি প্যান্ট বা শার্ট নেয়ার মানসিক তাগিদ বোধ করত না, কারণ এক রঙ বা এক ডিজাইনে একটির বেশি দুটি প্যান্ট বা শার্ট পরার আগ্রহ সাধারণত কারো হয় না। বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙের ফলেই প্রত্যেক ছেলে একটির জায়গায় পারলে পাঁচটি ব্যবহারে প্রলূদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
শেখ সাহেব যদি ইচ্ছা প্রকাশ করতেন যে নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি বা সদিচ্ছা প্রকাশের জন্য যে দেশই কাপড় পাঠাক না কেন সব কাপড়ই তাঁর নির্দেশিত ডিজাইনের এবং রঙের হতে হবে আমাদের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা তাদের নিম্নতম প্রয়োজন নিয়ে সন্তষ্ট থাকত এবং যেহেতু প্রত্যেক গজে বাংলাদেশের আদ্যাক্ষর ছাপা থাকত তাতে কোনো কাপড়ই বর্ডার পার হত না। অবশ্য আদ্যাক্ষরটি যেন কালিতে ছাপা উচিত হত যা অন্তত দু’বার ধুলেই মুছে যেত। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য যে, আনকোরা কাপড়ই সাধারণত বিদেশে পাচার হয়। দাগ মোচার জন্য একবার দু’বার ধোয়ার প্রয়োজন হলে সে কাপড় সীমান্ত পাচারকারীরা কখনো ক্রয় করে না।
আওয়ামী লীগ সরকার যদি কাপড়ের ব্যাপারে এ পদক্ষেপ নিতেন তবে সুবিধা হতো যে রাস্তা ঘাটে যত ছেলে মেয়েদেরকে দেখা যেত তাদেরকে সাধারণত একই রঙের কাপড়ে দেখা যাওয়ার ফলে সমগ্র দেশের ছেলে মেয়েদের মধ্যে একটা ঐক্য ও ভ্রাতৃস্বভাব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যেত। অনেকে মনে করে যদি তখন দেশি মিলগুলোকেও একই ডিজাইনের এবং রঙের কাপড় তৈরি করার নির্দেশ দেয়া যেতো তবে দেশের পক্ষে অতি মঙ্গল হতো। একই ধরনের কাপড় পরতে সবাইকে বাধ্য করলে আপামর সমস্ত বাংলাদেশের লোক তাদের নিম্নতম প্রয়োজনের বেশি কাপড় ব্যবহার করতে আগ্রহী হতো না। তাতে তখন দেশব্যাপী কাপড়ের যে আকাল পড়েছিল সেটার অভাব কিছুটা মিটে যেত। দ্বিতীয়ত দেশের অধিকাংশ মানুষ একই রঙ ও নমুনার কাপড় পরলে নিজেদের মধ্যেও একটা একতা ও সাম্যের ভাব জেগে উঠত একটা নতুন জাতিকে একই চিন্তা ও কর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যেটা অতীব প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতার পর-পরই সমগ্র বাংলাদেশের লোককে একই মন ও মানসিকতায় গড়ে তোলার জন্য এরূপ একটি পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন ছিল মনে হয়।
এক্ষেত্রে আমরা চীনের উদাহরণ দেখতে পারি।’৪৯ সনে চীন হওয়ার পর সরকার পুরুষ ও নারীদের সমগ্র দেশব্যাপী গাঢ় সবুজ রঙের এক প্রকার শেডের কাপড় পরা বাধ্যতামুলক করে দিয়েছিল। চেয়ারম্যান মাও সেতুং হতে আরম্ভ করে কৃষক শ্রমিক সবাই একই রঙের এবং একই খতের তর কাপড় পরতে আরম্ভ করল। তাতে ধনী দারিদ্রের পার্থক্য বেশভূষায় আর রইল বাধ্যতামুলকভাবে এই একই রঙের পোশাক পরিধানের নির্দেশ প্রথম ১৫/১৬ বৎসর ছিল। তারপর জাতি গঠনের ভিত্তি যখন সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হলো এবং এর মধ্যে মিলগুলিও প্রচুর উৎপাদনের মারফত দেশের প্রয়োজন পূর্ণভাবে মেটাতে সক্ষম হলো তখন পোশাকের ব্যাপারে সে দেশে আর আগের মত রইল না।
অনেকে মনে করেন চীনের মতো নারী পুরুষের একই পোশাক আমাদের। দেশে তখন প্রচলন করা সম্ভব না হলেও সমগ্র নারী সমাজের জন্য এক প্রকার এবং পুরুদের জন্য অন্য রকমের পোশাক প্রবর্তন করা সম্ভব ছিল। স্বাধীনতার পর-পরই এটা করা অবশ্য সম্ভব ছিল না। তবে দু’তিন বৎসরের মেয়াদী একটা সুচিন্তিত প্রোগ্রাম নিলে এটা কার্যকরী করা অসম্ভব ছিল না।“৭২ সনে জনসাধারণের ওপর শেখ সাহেবের যে অসাধারণ প্রভাব ছিল তিনি যদি এরূপ কোনো কার্যক্রম দেশবাসীকে দিয়ে গ্রহণ করাতে চাইতেন সেটা বোধ হয় পারতেন। পোশাকের ব্যাপারে এইরূপ কোনো বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেয়া জাতীয় জীবনে সুদুরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হতো।
পোশাকের ঐক্য নয়, মানুষের মধ্যে চিন্তার ঐক্যও আনয়ন করে। শুধু চিন্তায় ঐক্য নয়, মানুষের মধ্যে শৃংখলা বোধেরও জন্ম দেয়। সৈন্য বাহিনীতে সদস্যদের যদি প্রত্যেককে তার পছন্দমতো পোশাক পরার অধিকার দেয়া হয় তবে মুহূর্তে তার সমস্ত ঐক্য, শৃংখলা এবং কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। চীন দেশের নেতৃবৃন্দ নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশবাসীকে সুশৃংখল নিবেদিত প্রাণ একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা নিয়েই পোশাকের ব্যাপারে এতটা কঠোর নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন।
অনেকে মনে করেন শৃংখলা ও চিন্তার ঐক্যে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালিদের জন্য এমনি ধরনের কাছাকাছি একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এতে নতুন নতুন ডিজাইনের কাপড় করায়ত্ত করার জন্য যে চরিত্র হননকারী প্রতিযোগিতা চলেছিল তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া অতিক্রমও বন্ধ হতো। এ ধরনের সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্য বিপ্লবী জ্ঞান ও পড়াশোনা প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগের তধানীন্তন নেতাদের এ ধরনের পড়াশোনা প্রায় কারোরই ছিল না যে দু’চার জনের কিছু-কিছু ছিল তখনকার পরিস্থিতিতে তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগও প্রায় ছিল না বললেই চলে।

১৯৭২ সনে অবাঙালিদের পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা ও বাবসা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে কোনো প্রকার ইনভেন্ট্রি তৈরি না করেই যাকে তাকে পরিচালক বানিয়ে সেগুলি চালাতে দেয়া হলো। ইনভেন্ট্রি তৈরি না করে চালাতে দেয়ার দারুণ কারখানা চালু করার সময় তৈরি মালের স্টক কত ছিল তা আর কারো জানার উপায় রইল না। ফলে আরম্ভ হলো যথেচ্ছ লুট। তখন এক একটি কল কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার তৈরি মাল ছিল। একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশব্যাপী যুদ্ধ চলার দরুন কারখানাতেই প্রচুর উৎপাদিত মাল জমা হয়েছিল। ‘৭২-এর প্রথম খেকেই ওই সমস্ত মাল লুট হতে আরম্ভ হলো।
লুট প্রথমে আরম্ভ করল ১৬ ডিভিশন নামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। তারপর আরম্ভ করল পরিচালনায় যারা নিয়োজিত হয়েছিল তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। এর সম্পদ বাঙালি যুবকেরা কখনো এক চোখে দেখেনি। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই লুটের একটা সর্বগ্রাসী বন্যায় দেশ তলিয়ে গেল। সে বন্যায় কোথায় ভেসে বাঙালি যুবকদের দেশপ্রেম, তারপর আরম্ভ হলো লুণ্ঠিত অর্থ নিয়ে বাড়াবাড়ি। অবাঙালিদের পরিত্যক্ত বাড়ি ঘরের ব্যাপারেও একই ঘটনা ঘটেছিল। কোটি-কোটি টাকার এ সমস্ত বাড়ি-ঘর দখল ও করায়ত্ত করার জন্য দেশের সর্বস্তরের হাজার-হাজার মানুষ সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় এলটমেন্ট করিয়ে নেয়ার জন্য এক অশুভ প্রতিযোগিতায় হাজার-হাজার জাল দলিল তৈরি হতে লাগল।
মোটা ঘুষের বিনিময়ে একই বাড়ির তিনজনকে এলটমেন্ট দেয়া হতে লাগল।। ফলে দখল নিয়ে আরম্ভ হলো মারামারি, খুনোখুনি। ১৯৭২ সন হতে ১৯৭৪ সনের শেষ পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী যুবকদের মধ্যে যে হানাহানি গুপ্ত হত্যা প্রভৃতি চলেছিল তার অধিকাংশই হলো লুট লব্ধ এ অর্থের লুটের মূল লক্ষ্যই ছিল যেনতেন প্রকারে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন। তখন যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল তার জের এখনো চলে আসছে। দেশ জাহান্নামে যাক, তাতে ক্ষতি নেই আমার দু’পয়সা হলেই হলো। আজ সমাজের দিকে তাকালে আতঙ্কিত হতে হয়। যে কোনোভাবে অর্থ উপার্জনের একটা উন্মত্ত প্রয়াস ও সর্বনাশকর মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের এহেন অবনতি দেখে দেশের স্থায়িত্ব সম্বন্ধেও মানুষের মনে আজ সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ব্যবসা বাণিজ্যের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে লুটপাট, ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে জনজীবন অচল হয়ে উঠেছে। এদিকে শিল্প গঠনের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলেছে ডাকাতি ও পুকুর চুরি। ফলে ডেট দেনা সার্ভিসিং-এর পরিমাণ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দুর্নীতি সমাজের সর্বস্তরে এখন সর্বগ্রাসী আকারে দেখা দিয়েছে যে কোনো নতুন সরকার এসে যদি দেশের মঙ্গলজনক কিছু কাজ করার চেষ্টাও করে তবে যে চেষ্টাকে রূপ দেয়ার মতো উপযুক্ত সংখ্যক অফিসার, কর্মচারী বা কর্মী আদৌ পাওয় যাবে কি-না সন্দেহ হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করলে মনে হয় ২৫ বৎসর হতে শাসন ও শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের যতটুকু দুর্বল ও চারিত্রিক অধঃপতন ঘটাতে পারেনি ৭১” সনের পরে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি লুটের সুযোগ দিয়ে বাঙালিদের চারিত্রিক অধঃপতন তার চাইতে অনেক বেশি ঘটাতে পেরেছে।
যুবকরাই হলো দেশের ভবিষ্যৎ। সে যুবক সম্প্রদায়ই বলতে শেষ হয়ে গেল। আর্থিক অব্যবস্থা এবং তেলের কারণে হঠাৎ জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোন্দল ও সার্বিক দুরাবস্থার জন্য পারস্পরিক দোষারোপ মানুষের বিভ্রান্তি এবং জনমনে হতাশা সৃষ্টি করতে কম সাহায্য করেনি। শেখ সাহেব ১৯৭২ সনের শেষ থেকে ১৯৭৪ সনের মধ্যে দলের এমপি, এমএনএ ও উপমন্ত্রীদের মধ্যে দু’বার শুদ্ধি আন্দোলন পরিচালনা করেন। অনেক এমপি, এমএসএ-কে তিনি দুর্নীতির অপরাধে অনেক মন্ত্রী উপমন্ত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিসভা হতে বাদ দেন।
এসব পরিষদ সদস্য মন্ত্রী উপমন্ত্রীদের মধ্যে সবাই যে দোষী ব্যক্তি ছিলেন এমন নয়, বহু দোষীর সঙ্গে নির্দোষীও শাস্তি পেয়ে গিয়েছিল। এতে তার নিরপেক্ষতা, বিবেচনা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে জনমনে বারে বারে সন্দেহ দেখা দিতে লাগল। তিনি নিজে বহুবার বহু বক্তৃতায় একথা বলতে লাগলেন যে তিনি বিদেশ থেকে যা কিছু নিয়ে আসেন চাটার দলের তা থেকে নিঃশেষ করে ফেলে। এ চাটার মূল বলতে তিনি আওয়ামী লীগের কিছু লোককেই বুঝিয়েছিলেন। ফলে তিনি হয়তো সত্য ভাষণের জন্য সাময়িকভাবে কিছুটা ব্যক্তিগত বাহবা পেয়েছিলেন কিন্তু দল হিসেবে লোক চক্ষুতে আওয়ামী লীগের স্থান যে অনেকটা নিচে নেমে গিয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এছাড়া দু’দু’বার পুষ্টি আন্দোলনকেও অনেকেই তাঁর ডুবন্ত জাহাজ থেকে মালপত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষার অসহায় প্রয়াস বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটাকে ইংরেজিতে জেটিসনিং বলা হয়। অনেকে মনে করেন ক্রমাগত ভুল নীতির ও সিদ্ধান্তের ফলে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য হঠাৎ করে অত্যধিক বেড়ে গেল তখন দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাস হতে দেখে শেখ সাহেব অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছেন। আন্দোলনও সম্পূর্ণ নির্ভুল ফলপ্রসূ হয়নি। জনসাধারণ দেখল অনেক নিন্দিত ও ধিকৃত মন্ত্রী উপমন্ত্রী গদিতে রয়ে গেল আবার যাদের সম্বন্ধে তেমন কিছু শোনা যায়নি তারা কচুকাটা হয়ে গেল। এসব দেখেও পার্টির প্রতি জনসাধারণের আস্থা অনেকটা কমে গেল।
তারপর আরম্ভ হলো ছাত্রলীগের মধ্যে বিরোধ।শেখ মনির নেতৃত্বে ছাত্রলীগের এক অংশ এবং সিরাজুল আলম খান ও আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বে আর এক অংশ যথাক্রমে সোহরাওয়াদী উদ্যানে ও পল্টন ময়দানে দু’টি আলাদা কনভেনশনের আয়োজন করে। জাতির পিতা হিসেবে শেখ সাহেবের কোনোটিতেই যাওয়া উচিত ছিল না কিন্তু শেখ মনির পীড়াপীড়িতে তিনি সোহরাওয়াদী উদ্যানে গিয়ে নিজেকে এক গ্রুপের সঙ্গে চিহ্নিত করে অপর গ্রুপের ভীষণ বিরাগভাজন হলেন। এ সময় ছাত্রলীগের অপর গ্রুপটি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এ ঘটনার পর থেকে তারা বক্তৃতা, লেখনী ও প্রচারণার মাধ্যমে শেখ সাহেবের ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে আরম্ভ করল। এ ছাড়াও এসময় স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাঁর নেতৃত্বে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল তাঁর সঙ্গে শেখ সাহেবের বিরোধ এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা থেকে তাজুদ্দীনের বহিষ্কার শেখ সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাধুতা সমাপ্ত বুদ্ধীজীবী মহলকে সন্দিহান করে তোলে।
উপরে উল্লিখিত কারণগুলো আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বহুল পরিমাণে নষ্ট করে দিয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে যাদের বাস, যেমন গ্রামাঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যারা রাজনৈতিক মতামত সৃস্টি করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় তাদের আওয়ামী লীগ থেকে সরে যাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মনে হয়। হঠাৎ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তা সমাধানের ব্যর্থতা স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার দেশের প্রাচীন বয়স্ক অংশের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরক্তি যতটা না সৃষ্টি করতে পেরেছিল তার চাইতে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ ও তৎসহ ছাত্রলীগের কর্মীদের পাকিস্তানের প্রতি মনোভাব দর্শনে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা আপত্তিজনক ভাষায় পাকিস্তান ও তার দ্রষ্টাদের ইংরেজের দালাল, দেশের শত্রু, বাঙালির শত্রু বলে নিন্দা করতে লাগল। আমাদের প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যারা ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সন পর্যন্ত মনেপ্রাণে

আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে এসেছিল তারা মনে করে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল না, বিরোধ ছিল পাকিস্তানের শাসক তারা মনে করে ১৯৪৬ সনে ভোট দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করে তারা ভুল করেনি। তদানীন্তন অখণ্ড ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনে ভারতীয় মুসলমানরা যখন তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল তখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাকে আলাদা করে হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা পাকিস্তান আন্দোলন আরম্ভ করে।
পাকিস্তানকে তারা ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় আবাস ভূমি হিসেবেই কল্পনা করেছিল। এই আবাস এ জন্য আন্দোলন সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলেই তারা মনে করে। তারা মনে করে এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে যাই মনে হোক না কেন পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে ভারতীয় মুসলমান তথা অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ভ্রান্ত পদক্ষেপ ছিল না। তারা মনে করে ভারত বিভক্ত না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক এলাকা আমরা দেখতে পাই এটি অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে থেকে যেত। তাতে স্বাধীন বাংলা উৎপত্তি কখনো হতো না। স্বাধীন পাকিস্তান হয়েছিল বলেই আজকে স্বাধীন বাংলার উৎপত্তি সম্ভব হয়েছে। অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে থাকলে তার থেকে আলাদা করে নিয়ে পাকিস্তানী মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন কখনোই সম্ভব হতো না। ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে শিখেরা হাজার চেষ্টা করেও নিজেদের স্বায়ত্বশাসিত আবাসভূমি সৃষ্টি করতে পারছে না। ভারতের পূর্ব প্রান্তে নাগা ও মিজোরা গত দুই দশক ধরে আপ্রাণ থেকে তাদের এলাকাকে মুক্ত করতে পারছেনা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিশেষভাবে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন অতি আপত্তিজনক ভাষায় হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও মাওলানা ভাসানী ছাড়া পাকিস্তান আন্দোলনের সকল নেতা এমন কি পাকিস্তানের স্থাপিত কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ সকলের সম্পর্কেই অসম্মানসূচক কথাবার্তা বলতে লাগল তখনই প্রাচীন ও বয়স্করা মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত আঘাত পেল।
এটা স্মরণযোগ্য হয় ৬ দফা আন্দোলনের কোথাও পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। ৬ দফা বিশ্লেষণ করলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে পুরোপুরি রক্ষা করার জন্য কনফেডারেশন জাতীয় একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করে পাকিস্তানকে অটুট রাখার কল্পনাই মুলত শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ছিল, এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু ভুট্টোর জিদ ও ইয়াহিয়ার মুর্খতায় শেষ পর্যন্ত ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম পুরোপুরি স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়।
পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা যারা ৬ দফায় ভেটো দিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়ে এসেছিল, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত-তাদের কারো কাম্য ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানীর সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী যখন পূর্ব (কুমিল্লার কসবা এলাকার এক মহিলা এমপি-র বাড়িতে রিলিফের কয়েক হাজার শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল ও কয়েকশ’ দুধের টিন উদ্ধার হয়…।
শোনা যায় ওই সুন্দরী মহিলা এমপি শেখ ফজলুল হক মনির খুব স্নেহভাজন ছিল বলে শেখ সাহেব এ ব্যাপারে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেননি) পাকিস্তানের নির্বাচনের রায়কে উপেক্ষা করে গণহত্যা চালাতে আরম্ভ করল তখন এদেশের লোকেরা পরিষ্কার বুঝতে পারল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোন প্রকারেই একত্র থাকা সম্ভব হবে না।
তখনই তারা অনন্যোপায় হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু তাই বলে ১৯৪৬ সনে ভোট দিয়ে যে পাকিস্তান তারা গড়েছিল সেটা ভেঙে টুকরা-টুকরা হয়ে যাক এটা এদেশের অধিকাংশ জনসাধারণ কামনা করেনি। তাদের মনোভাব ছিল যেন একটি যৌথ পরিবারের দুই ভাই অনেকদিন একত্রে থাকার পরে এক ভাই দেখল অন্য ভাই তাকে ক্রমাগত ঠকাচ্ছে এবং তার ন্যায্য পাওনা দিচ্ছে না তখন ক্ষতিগ্রস্ত ভাই জোর করে অন্য ভাই-এর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল। আলাদা হয়ে গেলেও অপর ভাইয়ের প্রতি তার পূর্ণ শুভেচ্ছাই বর্তমান ছিল।
সে ভাই ধ্বংস হয়ে যাক এটা যে মনে প্রাণে কোনো দিনই কামনা করেনি। বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৩ সনে ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এলে অভাবিতপূর্ব গণসংবর্ধনা পেয়েছিল পাকিস্তানের প্রতি শুভেচ্ছার এটাই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভুট্টো ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর যখন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ছাত্রলীগ কর্মীরা পাকিস্তানের নিন্দায় মুখর হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের যৌক্তিকতাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল কোটি-কোটি লোক যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং এর সাফল্যের জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে তাদের মনে দারুণ সন্দেহ দেখা দিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম বদলে সূর্যসেন হল, ইকবাল হলকে সার্জেন্ট জহরুল হক হল ও জিন্নাহ এভিনিউকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করা হলো। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে এসবের কী প্রয়োজন ছিল।
বাঙালি মাত্রই সূর্যসনের নামের প্রতি অতন্ত প্রাণী। বিদেশি শাসকের নাগপাশ থেকে পাকভারত উপমহাদেশের মুক্তির সংগ্রামে তাঁর অবদান অবিস্বরণীয়। তাঁকে সম্মান দেয়ার জন্য নতুন কোনো হলের নামকরণ তাঁর নামে করা যেত। কিন্তু কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যাকে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল এরূপ বিরাট একটি জনগোষ্ঠী অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখত, তাঁর নাম পালটিয়ে সূর্যসেন হল করা কখনো উচিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নামে আলাদা রাস্তার নামকরণ করা যেত। জিন্নাহ্ এভিনিউর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ যাঁরা করেছিলেন তাঁরা জিন্নাহ সাহেবের প্রতি যেমন অবিচার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিও তেমনি সত্যিকারের শ্রদ্ধা দেখাননি, এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। এখানে স্মরণীয় যে ভারত বিভক্তির ব্যাপারে জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস নেতাদের যত মতবিরোধ ও যত শত্রুতাই হোক না কেন, তাঁরা বোম্বের বিখ্যাত পাবলিক হল জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করেননি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তদানীন্তন তরুণ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তখনকার বোম্বের নাগরিকবৃন্দ চাঁদা তুলে এই পাবলিক হলটি তৈরি করে। পরবর্তীকালে জিন্নাহ সাহেব কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দিলেও কংগ্রেস নেতারা হলের নাম পরিবর্তনের কথা কখনো চিনতা করেনি। দেশ বিভক্ত হওয়ার পর কাশ্মীর ও অন্যান্য ইস্যুতে হিন্দুস্থানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘোর শত্রুতা হওয়া সত্বেও করাচির গান্ধী গার্ডেনের নাম পাকিস্তান সরকার পাল্টিয়ে দেয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর আমরা তাই করেছি। বিশিসষ্ট দার্শনিক, কবি ইকবাল সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। বাংলাদেশ হওয়ার পর-পরই আমরা তাঁর নাম বদলিয়ে হলের নাম রাখলাম সার্জেন্ট জহরুল হক হল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্জেন্ট জহুরুল হকের অবদান অসামান্য। তাঁর হত্যাকাণ্ডই দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ব মুহূর্তে শুষ্ক বারুদ-স্তুপে জ্বলন্ত কাঠির ন্যায় বিস্ফোরণ ঘটাতে সাহায্য করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান অপরিসীম, কিন্তু তাই বলে এক কালে পাক-ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের নিকট যিনি অতীব শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন সেই মহাকবি ইকবালের নাম পরিবর্তন করে সে হলের নাম সার্জেন্ট জহরুল হক রাখা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। সার্জেন্ট জহরুল হককে সম্মান দেয়ার জন্য তার নামে কোনো নতুন হল করলেই চলতো বা নতুন কোনো রাস্তার নামকরণ করলেই হতো। এখানে স্মরণীয় যে ভারত সরকার ইকবালকে ভারতের অন্যতম জাতীয় কবি হিসেবে বহু আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পশ্চিম বঙ্গের বামপন্থী সরকার কয়েক বৎসর পূর্বে ইকবাল একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে এই মহান দার্শনিক কবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। কারো অতীতের সুকর্ম বা অবদান অতি শীঘ্র স্কুলে যেতে আমাদের সমকক্ষ বোধহয় এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আজ যাকে মাথায় নিয়ে নাচি কাল তাকে পদদলিত করতেও আমাদের বাধে না।
এভাবে নাম বদলানোর ফলে স্বভাবতই দেশের প্রবীণ ব্যক্তিবৃন্দের ধারণা হলো আমাদের যুবক শ্রেণি আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিজাতীয় ভাবধারায় উদ্বৃত্ত হয়ে অন্যের ইঙ্গিতে আমাদের অতীতের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে। ভারতের সাহায্যে দেশ স্বাধীন হোক এটা এদেশের অনেকেরই কাম্য ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে ভারতের সাহায্য না নিয়ে উপায় ছিল না। যে কোনো কারণেই হোক এদেশের অধিকাংশ লোকের ধারণা ছিল যে ভারত মনেপ্রাণে পাকিস্তান ও পাকিস্তানের মুসলমানদের মঙ্গল কোনোদিন চায়নি।পাকিস্তানকে ভাঙার লক্ষ্যেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে এত সাহায্য করেছিল, এদেশের লোকের সত্যিকার মুক্তির জন্য সাহায্য করেনি।

তাদের এ ধারণা সত্য কি মিথ্যা সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তবে যখন বাংলাদেশ হয় তখন দেশের অধিকাংশ লোকের মনোভাবই এরূপ ছিল। ঠিক এ সময়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের এ ধরনের বক্তব্য আচরণে বুদ্ধিজীবী মহলের ধারণা হলো আওয়ামী লীগ ভারতীয় চিন্তা ও প্রভাবে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। ধীরে-ধীরে কার্যকারণে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে লাগল যে ভারতীয় স্বার্থ ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস আওয়ামী লীগের নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ কর্মীদের পাকিস্তানের প্রতি এ বিরূপ মনোভাবের জন্য দোষ দেয়া যায় না। জন্মের পর থেকে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারের কথা শোনার ফলে ছাত্র ও কর্মীদের কাছে পাকিস্তান এবং তার শাসক গোষ্ঠী সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যায় ও অভিচারের ক্রমাগত শিকার হতে-হতে পাকিস্তান থেকে তার শাসক গোষ্ঠীকে আলাদাভাবে বিবেচনার ক্ষমতাও অধিকাংশ যুবক ও আওয়ামী লীগ কর্মী হারিয়ে ফেলেছিল। তাই এদেশের তরুণ সমাজ সহজেই পাকিস্তান বিরোধীদের সুকৌশল প্রচারণার শিকার হয়ে পড়েছিল।
সব চাইতে দুঃখের ও ক্ষতির কারণ হলো যখন শেখ মুজিব বাংলাদেশ হওয়ার পর-পরই ঘোষণা করলেন যে ১৯৪৮ সন থেকেই তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছেন। স্বাধীনতার পর-পরই কে কত পাকিস্তান বিরোধী ছিল তা তা প্রমাণ করার জন্য যেন একট প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছিল।
পাকিস্তান বিদ্বেষের পরিমাণ তখন যেন স্বদেশপ্রেমের গভীরতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। শেখ মুজিবের সেদিনের উক্তি যে কত অসত্য ও ভিত্তিহীন ছিল ১৯৫৪ এবং “৫৫ সনে শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর ১৪ আগস্ট প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির পুরনো রেকর্ড খুলে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৭২ সনে ভাবপ্রবণতার জোয়ারে যখন দেশের মানুষ ভেসে চলেছে এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড স্মৃতি মানুষের মনে জ্বল জ্বল করছে এ সময় শেখ মুজিবের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শ্রদ্ধেয় নেতার সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য এই অসত্য ভাষণ যে প্রবীণ ও সুধী সমাজকে কতটা হতচকিত ও হতভম্ব করে দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত তাদের চোখে কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছিল তা গভীরভাবে ভাববার বিষয়। ফলে আওয়ামী লীগ থেকে দেশের বুদ্ধিজীবী ও প্রবীণ মহল ক্রমাগত সরে যেতে লাগল। এভাবে আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ল জনসাধারণের আস্তাহীন কিছু নেতা ও বেশ নিষ্ঠাবান কর্মীর সংগঠন।
১৯৭৫ সনের জানুয়ারি মাসে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে অবস্থা আয়ত্তে আনার অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তখন কত দেরি হয়ে গেছে। ৭২ সন থেকে ধারাবাহিকভাবে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছিল তার ফলে তখন যে কাজই তিনি করতে চাইতেন তাতে লোকে উদ্দেশ্য আরোপ করতে লাগল।
(আরম্ভ হলো ছাত্রলীগের মধ্যে বিরোধ… সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও পল্টন ময়দানে দু’টি আলাদা কনভেনশনের আয়োজন করা হয়…. জাতির পিতা হিসেবে শেখ সাহেবের কোনোটিতেই যাওয়া উচিত ছিল না কিন্তু শেখ মনির পীড়াপীড়িতে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে নিজেকে এক গ্রুপের সঙ্গে চিহ্নিত করলেন)
এসব আত্মীয়-স্বজনের ক্রিয়াকর্মের শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে যায়। তাই’৭২ সনে তাঁর পড়ে যা সম্ভব ছিল ‘৭৫ সনে আর তা সম্ভব হয়নি। তাই তাঁর শক্ততা এ সময় তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তারা স্থির নিশ্চিত হয় যে এ সময়ে তাঁকে হত্যা করলে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। তাদের ধারণা যে সঠিক এটা তাঁর হত্যার পর প্রমাণিত হয়ে গেল।কাউকে শাস্তি দিলে লোকে মনে করত তার পরিবারের কারো সঙ্গে নেতৃস্থানীয় কারো তার পরিবারের কারো সঙ্গে স্বার্থের বিরোধ হওয়ায় উক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে।
এ সময় আওয়ামী লীগ কর্মী ও জাসদের কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চরমে ওঠে। জাসদ কর্মীদের হত্যা করার জন্য ঢালাওভাবে মুজিব বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল বলে গুজব রটে। ব্যাপারটা কতটুকু সত্য বলা যায় না তবে উভয় পক্ষে বিশেষ করে জাসদের পক্ষে প্রচুর কর্মী যে নিহত হয় এটা অস্বীকার করা যায় না। এ সময় গ্রাম গঞ্জের অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত না। সরকারের ওপর জনসাধারণের আস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে যখন দাঁড়াল ঠিক সে সময় শেষ চেষ্টা ‘৭৫-এ বাকশাল গঠন করলেন।
এটা যে দেশের সর্বসাধারণের মনে উৎসাহ জাগিয়ে দেশব্যাপী একটা সাড়া জাগাতে পেরেছিল এমন নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে তিনি যখন বাকশাল ঘোষণা করলেন অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে তখন বিভিন্ন মহল থেকে বাকশালের প্রতি মৌখিক সমর্থন জানান হলেও তার সঙ্গে দেশের মানুষের কোন সংযোগ ছিলনা। প্রতিবিপ্লবীরা যখন বুঝতে পারল শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ জনসাধারণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তখনই তারা ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাত্রে আঘাত হানল। শেখ সাহেব, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ জলুল হক মনি সবাই সপরিবারে নিহত হলেন। ক্ষমতা আওয়ামী লীগ পার্টির হাত থেকে চলে গেল কত দিদের জন্য কে জানে?
১৯৭৩ সনের প্রথমে তিনি দুর্নীতি ও অরাজকতা দমনের জন্য যে কঠোর পন্থাসমূহ বা সে বৎসরের মাঝামাঝি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাকশাল নামে যে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এর সবগুলিরই সাফল্যের জন্য প্রচুর জনসমর্থন প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর কিছুদিন যাবৎ শেখ সাহেবের যে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল তখন উপরিউক্ত উদযোগুলির জন্য সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনে যেকোনো পরিকল্পনা সফল করার ইচ্ছা করলেই তিনি অতি সহজেই তা করতে পারতেন। কিন্তু তখন যেটা অতি সহজ ছিল ১৯৭৫ সনে সেটা মোটেই সহজ ছিল না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান সামর্থ সম্পর্কে লোকের মনে তখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাঁর পরিবারের অনেকের বিশেষ করে তাঁর ছেলে কামাল ও ভাগিনেয় ফজলুল হক মনির বাংলাদেশের তদানীন্তন রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে মাত্রাহীন প্রভাব বিস্তার জনসাধারণ ভালভাবে গ্রহণ করেনি।
শেখ সাহেবের তৎসময়ে গৃহীত অনেক পদক্ষেপের পিছনেই এদের অন্যায় প্রভাব ছিল বলে অনেকে মনে করে। এসব আত্মীয়-স্বজনের ক্রিয়াকর্মের ফলশ্রুতিতে শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা দ্রুত কম যায়। তাই “৭২ সনে তাঁর পক্ষে যা সম্ভব ছিল “৭৫ সনে আর তা সম্ভব হয়নি।
“৭১ সনের ১০ মার্চে ইয়াহিয়া খান গণপরিষদ স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে হাজার-হাজার মানুষ অফিস আদালত ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল পাক আর্মির গোলাগুলির ভয় না করে, সেখানে এত বড় একজন সাহসী পুরুষ যাঁর নামে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, লক্ষ-লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছিল, যাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোদিনই সম্ভব হতো কি না সন্দেহ, তাঁকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হলো দেশব্যাপী কোথাও প্রতিবাদের ঝড় উঠল না। এটাতেই বোঝা যায় শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ সরকার ৭৫ সনে জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ থেকে কতদূর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে শেখ সাহেবের অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং যার জন্য বাংলাদেশের লোক চিরদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে সেটা হলো ভারতীয় বাহিনীর অপসারণ। শেখ মুজিব ফিরে না এলে স্বাধীনতার পর-পরই বিভিন্ন দল ও নেতাদের মধ্যে এমন কোন্দল আরম্ভ হতো যার ফলে দেশব্যাপী এমন অরাজকতার সৃষ্টি হতো যে ইন্দিরা গান্ধীর শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা সম্ভব হতো না। শুধু শেখ সাহেব ফিরে আসাতেই সাময়িকভাবে হলেও দেশে কিছুটা শান্তি শৃংখলা ফিরে এসেছিল এবং ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব হয়েছিল।
শেখ সাহেব যেদিন নিহত হন সেদিন যদি ঢাকা শহরে ৫০০ লোক লাঠি হাতে শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসত তাহলেই ব্যাপার অন্য রকম হয়ে যেত। শেখ সাহেবের হত্যার সঙ্গে সমগ্র সেনাবাহিনীর ২ শতাংশ লোকও জড়িত ছিলনা। সর্বমোট ২০০ থেকে ২৫০ ট্যাংক বাহিনীর জওয়ান এবং দশ-বার জন আর্মি অফিসার জড়িত ছিল। পাঁচশত লোকও শ্লোগান দিয়ে বেরিয়ে এলে রক্ষীবাহিনীর লোকেরাও বেরিয়ে আসত। ফলে হত্যাকারীরা পালাবার পথ পেত না এবং আওয়ামী লীগও ক্ষমতাচ্যুত হতো না। এদেশের মানুষ শেখ সাহেব শক্ত হোক, সংশোধিত হোক এটাই চেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী অতি অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া তার এই অপ-মৃত্যু ঘটুক এটা কেউ কামনা করেনি।